অনলাইন ডেস্ক : কোরবানির ঈদ অত্যাসন্ন, তাই সংগত কারণেই গরু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হলো। গরু গৃহপালিত নিরীহ পশু হলেও মানব জীবনে গরুর অবদান অনস্বীকার্য। গরু আপাদমস্তক উপকারী প্রাণী, যার প্রতিটি অঙ্গ আমাদের উপকারে আসে। গরু একটি বোবাকালা প্রাণী, তাই সে মনের ভাব ভাষার সাহায্যে মনুষ্যসমাজকে বোঝাতে পারে না। তাতে কী হয়েছে, গল্পের গরু তো কথা বলতে পারে। এক দিন কথা প্রসঙ্গে সে বলল-“আহারে মানবজাতির কান্ডকারখানা দেইখা কেবলই হাসি পায়, দুঃখও লাগে। তারা কথায় কথায় মানুষকে গরুর সঙ্গে তুলনা করে। টেলিভিশনে টকশোতে, রাজনীতির সমাবেশে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে এরা যে কী হারে মিথ্যা কথা বলে আমরা গরু জাতি হয়েও ভাবিতে লজ্জা লাগে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হইল মানবজাতির লোভ আর প্রতারণার ফাঁদে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে। আহারে-মানুষ কত খারাপ, আমাদের নিরীহ জীবন নিয়েও মিথ্যাচারের বাণিজ্য করে। এই দেখুন না- কারওয়ান বাজার আর কাপ্তানবাজারে ভোর রাতে জবাই হওয়া মহিষের মাংস সকালে দিনের আলোয় মাংসের বাজার আর হোটেলে গরুর মাংস বলে দেদার বিক্রি হচ্ছে। আর হোটেলে গিয়া মানুষরা এই মহিষের মাংসকে গরুর মাংস মনে করেই খাচ্ছে। গরু হইলেও মাঝে মধ্যে আমরাও ভাবিয়া অবাক হই, এই মানবজাতি নিজেদের সঙ্গে এত বড় প্রতারণাও করিতে পারে !”
যাক গল্পের গরুতে বসে না থেকে বরং গরু নিয়ে কিছু রসালাপ করা যাক। ব্রিটেনে গরুকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী মনে করা হয়। কারণ ১৫ বছরে ব্রিটেনে ৭৪ জন প্রাণ হারিয়েছে গরুর আক্রমণে। হেলথ অ্যান্ড সেইফটি এক্সিকিউটিভ (এইচএসই)-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এক টনের বেশি ওজনধারী গরুরাই বেশি ভয়ঙ্কর। এরা শিংয়ে তুলে আছাড় মেরে বা কাউকে ধাক্কা মেরে প্রাণে মারতে পারদর্শী। এজন্যই সে দেশে গরুকে ভয়ঙ্কর প্রাণীদের তালিকার শীর্ষে রাখা হয়েছে।
গরু চুরি নিয়ে একটি কৌতুক আছে। ‘এক গৃহকর্তা গোয়ালাকে বলছে, এই মিয়া খাঁটি গরুর দুধ বলে তো দিলে। বাড়ি নিয়ে তো দেখি অর্ধেকটাই পানি। জবাবে গোয়ালা বলে, জনাব গরুটা খাঁটি বলেছি, দুধ তো খাঁটি বলিনি!’ সত্যিই তো- অনেক জায়গায় লেখা থাকতে দেখা যায় ‘খাঁটি গরুর দুধ’ কিন্তু বাক্যটি হওয়া উচিত ‘গরুর খাঁটি দুধ।’ দুধ ব্যবসার প্রচারণায় কী চমৎকার প্রতারণার ফাঁদ।
মাধ্যমিকে পাঠ্য গরুর রচনা প্রায় পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়েছে। গরুর রচনায় গরুর দৈহিক বর্ণনা, উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে। গরুর রচনায় এই বর্ণনার মধ্যে বাহুল্যতা বা অতি প্রশংসা নেই, বরং কমতি আছে। কিন্তু যা একেবারেই নেই তা হলো গরুদের দুঃখগাথা। গরু নিয়ে প্রবাদ প্রবচনেরও যেন অভাব নেই। ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’, ‘গরু খোঁজা’, ‘গরু মেরে জুতো দান’, ‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না’ ‘কাজির গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’-ইত্যাদি প্রবচন গ্রাম-বাংলায় বহুল প্রচলিত। গরুকে বাহারি নামে ডাকা এখন ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন- কালাপাহাড়, ধলাপাহাড় ইত্যাদি। তবে লিঙ্গ পরিচয়ে স্ত্রীবাচক নামে গাভি, গাই, ধেনু এবং পুরুষবাচক নামে ষন্ড, ষাঁড়, দামড়া, বৃষ, বলীবর্দ, বলদ, রোমন্থক পরিচয়ে চেনা যায়। গরুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু শব্দ যা মানবসমাজেও বহুল ব্যবহৃত। আগে মেয়েরা গাভি দোহন করত বলে ‘দুহিতা’ শব্দটি কন্যা অর্থে ব্যবহৃত। গোধূলি, গবাক্ষ, গোগ্রাস, গোধন, গোবেচারা ইত্যাদি ভিন্ন অর্থেও কিছু শব্দ গরুর সঙ্গে সম্পর্কিত।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটি গরুকে যদি বিশেষ নামে ডাকা হয় ও তার সাথে আলাদাভাবে আচরণ করা হয় তবে গরুটি ৫০০ পিন্টস (তরল পদার্থ পরিমাপের একটি বিশেষ পদ্ধতি) পরিমাণ দুধ বেশি প্রদান করে। আগের দিনের চেয়ে বর্তমান সময়ে গরুদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলেছে। মানে গরুর মূল্য বেড়েছে। কিভাবে বেড়েছে তা শুনে নিন গল্পের গরুর জবানিতে। গল্পের গরু বলছে-‘গরু নিয়ে বাঙালিদের চেয়ে ভারতীয়দের চেতনায় গরু জাতি ধন্য। কি যে গো-ভক্তি ভারতীয়দের। তারা মা জাতির সম্মান দেয়। ভক্তি করে, পুজো দেয়। আমাদের চনা খায় বাসনা পূরণের আশায়। আহা-হা-হা। তবে বাঙালিদের মাঝে শুধুমাত্র কোরবানির ঈদ এলেই আধুনিক গরুপ্রীতির এক নয়া রীতি লক্ষ করা যায়। বাঙালিরা এখন কোরবানির গরুর সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে। আমরা গরু, মানুষের মুখে শোনা কথাই বলি- কোরবানির নাম নিয়ে কে কত দামি, মোটা, তাজা গরু কিনেছে এই প্রতিযোগিতা নাকি ইসলাম সম্মত নয়।’
মানবদেহের জন্য প্রোটিন অত্যাবশ্যক আর প্রোটিনের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে গরুর মাংস। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ উপলক্ষে জবাইকৃত গরুর মাংসই সারা বছরের প্রোটিনের ঘাটতি বহুলাংশে পুষিয়ে দেয়। কিন্তু এই গরু বা গো-মাংস খাওয়া সিদ্ধ না নিষিদ্ধ তা নিয়ে কিছু দিন পর পরই তুলকালাম কান্ড ঘটে ভারতে। ভারতে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে রক্তপাতের আন্দোলন আমাদের মতো মুসলিম দেশের কাছে বিনোদনের খোরাক হয়েছে বৈকি। দুঃখের কথা হলো- আগেকার দিনের গরুপালন প্রীতির সেই গ্রামীণ রীতি এখন আর বাংলার গ্রামেও নেই। তাতে বরং গরুদেরই ভালো হয়েছে। এখন আর গরুদের হাড়খাটুনে পরিশ্রম করতে হয় না। ভোরবেলায় লাঠির গুঁতোয় চাষির হই হাঁট হাঁট নির্দেশ মান্য করে চলতে হয় না। কৃষকের গোয়ালে এখন গরু নেই। কলের লাঙ্গল এসে গরুর চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। কৃষিকাজে গরু পালন বন্ধ হওয়ার কারণে বাড়তি গরু উৎপাদন হচ্ছে না। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে মূল্য দিয়ে। কারণ এখন ২৫০ টাকার গরুর মাংস ৫০০ টাকায় উঠেছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে এখন মাসে এক-দুই কেজি গরুর মাংস জুটছে না। তবে আশার কথা হলো, কৃষকের ঘরে কৃষিকাজে বা শখে গরু পালন না হলেও এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে গরু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধ খামার। দেশের বিপুল জনসংখ্যার প্রোটিন চাহিদা বলতে গেলেই গো-খামারিরাই পূরণ করছেন। অবশ্য এ সুবাদে গরুদের দিনকাল ভালোই কাটছে। খামারের গরুরা এখন আরামে খায়, দায়, ঘুমায়। শুয়ে-বসে জাবর কেটে দিন কাটায়।
আসুন গল্পকথার গরুর মুখ থেকেই শুনি তাঁর দুঃখের কী কাহিনি আছে। গল্পকথার গরু বলছে- “শোনেন, গরু হইতে পারি, তাই বলে বিবেক বুদ্ধি যে একেবারেই নাই তা কিন্তু সত্যি নয়। দুঃখ লাগে- নিরীহ গরুজাতি প্রাণ বিসর্জন দেয় যে মানবজাতির জন্য- সেই মানবজাতি অতি লোভে গরু দ্রুত ওজনদার করার জন্য স্টেরয়েডসহ বেশকিছু হরমোন প্রয়োগ করে। এই হরমোন প্রয়োগকৃত গরুর মাংস খেলে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি গরু হইলেও আমার প্রশ্ন, এমন অপকর্ম করেও এসব অমানুষ কি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হতে পারে!” না, আর শোনার দরকার নেই। গরুর কাছে দুঃখের কথা জানতে চাইলে মানুষ হিসেবে আমরাই বরং লজ্জিত হব। সত্যটি হচ্ছে, গরু আর মানুষ বহুকাল থেকেই মিলেমিশে আছে। কারণ মানুষ আর গরুতে নাকি অনেক মিল। ২০০৯ সালে বিজ্ঞানীরা যখন প্রথম গরুর জিনোমের ম্যাপিং করে দেখলেন, গরুর দেহে ২২,০০০ জিন রয়েছে যার ৮০ শতাংশ জিনের সঙ্গেই মানুষের দেহে থাকা জিনের মিল রয়েছে। মানুষের মতো গরুদের নিজেদের মাঝে যথেষ্ট বন্ধুত্ব বিদ্যমান। গবেষণায় দেখা গেছে, একই পালের গরুদের পৃথক করে ফেলা হলে তারা বেশ অস্থির হয়ে যায়। তাদের হৃদস্পন্দনের হার কমে যায়। মানুষের বেলায়ও এ রকমই হয়। গরু নিয়ে আর জটিলতা নয়। একটা সহজ কৌতুকে লেখাটির ইতি টানি। জেলখানায় এক কয়েদিকে জেলার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী অপরাধে তুমি এখানে এসেছ? জবাবে কয়েদি বলল, এই হাত চারেকের মতো দড়ি চুরির অপরাধে। শুনে বিস্মিত হয়ে জেলার সাহেব বললেন, এতটুকু দড়ি চুরির অপরাধে তোমার জেল হতে পারে না। জবাবে কয়েদি বলল, স্যার, দড়ির মাথায় একটা গরু বাঁধা ছিল।